বান্দা মহান আল্লাহ এর খুব নিকটবর্তী হওয়ার জন্য তাহাজ্জুদ এর নামাজ আদায় করে। আমরা সকলেই জানি আমাদের উপর ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়েছে। আমাদের সকলের বাধ্যতামূলক এই নামাজ পড়তে হবে। এই ৫ ওয়াক্ত নামাজ ছাড়া আরো একটি নামাজ রয়েছে যেটি ফরজ নামাজের পর সবথেকে বেশি গুরুত্তপূর্ন এবং ফজিলতপূর্ন। এই নামাজের নাম হলো তাহাজ্জুদ এর নামাজ। আজকের কন্টেন্ট এ আমরা তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো এবং এর নিয়ত, ফজিলত, সময় এবং এর রাখাত সংখ্যা নিয়ে আলোচনা করবো। তাই পুরোটি পড়ার অনুরোধ রইলো।
তাহাজ্জুদ নামাজ কি?
তাহাজ্জুদ একটি আরবি শব্দ। এর বাংলা অর্থ এইরকম দাঁড়ায় যে রাতের নামাজ। একে কিয়ামুল লাইল ও বলা হয়। এই নামাজ সাধারনত রাতের মধ্যভাগে এবং ফজরের আযান এর আগে আদায় করা হয়। অর্থাৎ, মহান আল্লাহ কে সন্তুষ্ট করার জন্য রাতের মধ্যভাগে যে সালাত আদায় করা হয় তাকে সালাতুল তাহাজ্জুদ এর নামাজ বলা হয়।
তাহাজ্জুদ এর নামাজ কেনো পড়া হয়?
মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে ফরজ নামাজ এর পড়ে সবথেকে বেশি প্রিয় নামাজ হলো তাহাজ্জুদ এর নামাজ। আমরা সকলেই চাই মহান আল্লাহ এর কাছাকাছি যেতে। কারন আমাদের সকলেই চাওয়া এবং পাওয়া গুলো মহান আল্লাহ এর কাছ থেকে নিতে হয়। মহান আল্লাহ এর পছন্দনীয় কাজ গুলো করলে আমরা তার নিকটবর্তী হতে পারবো। মূলতো মহান আল্লাহ এর কাছে কোনো কিছু চাওয়ার জন্য এবং তার সন্তুষ্টি অর্জন করার জন্য এই নামাজ আদায় করা হয়। আমরা নিচে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম নিয়ে আলোচনা করবো।

তাহাজ্জুদ এর নামাজ নিয়ে বর্নীত কোরআন এর আয়াত
মহান আল্লাহ তায়ালা কোরআন মাজিদে তাহাজ্জুদ নামাজ এর কথা বলেছেন। পবিত্ত্র কোরআন এর সূরা বনী ঈসরাইল এর ১৭ নম্বর আয়াত এ বলেছেনঃ
“এবং রাতের কিছু অংশ তাহাজ্জুদ এর সালাত আদায় করুন। এটা আপনার এক অতিরিক্ত কর্তব্য । আশা করা জায় আপনার প্রতিপালক আপনাকে প্রতিষ্টিত করবেন এক প্রসংশিত স্থানে।”
উপরের আয়াত থেকে বুঝা জায় যে এই নামাজ অনেক গুরুত্তপুর্ন মহান আল্লাহ এর কাছে কোনো কিছু চাওয়ার অন্যতম মাধ্যম হলো এই নামাজ। আপনি যদি নিয়মিত তাহাজ্জুদ এর সালাত আদায় করেন তাহলে মহান আল্লাহ আপনাকে ইহকালে এবং পরকালে সম্মানিত করবেন ইনসাল্লাহ।
আরোও পড়ুনঃ জেনে নিন মনের আশা পূরণের দোয়া ও আমল কিভাবে করবেন
তাহাজ্জুদ এর নামাজ নিয়ে বর্নীত হাদিস
আমাদের প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মদ (সঃ) কখোনই তাহাজ্জুদ এর সালাত মিস করতে না। তিনি সব সময় এই সালাত আদায় করতেন। একরকম তার উপর এই সালাত ফরজ ছিলো। তিনি মহান আল্লাহ তায়ালার খুব কাছের মানুষ ছিলেন। মহান আল্লাহ এর সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য তিনি এই সালাত নিয়মিত পড়তেন। এমনকি তিনি এই নামাজ এতো বেশি লম্বা করে পড়তেন যে দারিয়া থাকতে থাকতে তার পা ফোলে যেতো। এই নিয়ে সহীহ বুখারি এর ১১৩০ নং হাদিসে বলা হয়েছে যে,
“মহানবী (সঃ) রাত্ত্রি জাগরণ করতে তাহাজ্জুদ এর সালাত আদায় করার জন্য, তিনি সালাত এতোটাই দীর্ঘ করতে যে যার কারনে পদযুগল ফোলে যেতো। ( সুবহানাল্লাহ)”
তাহলে বুঝতেই আপ্রছেন যে রাসুল (সঃ) কতো গুরুত্ত দিতেন এই সালাত কে। কিন্তু আমাদের বর্তমান সময়ে এ রাত্ত্রি জাগরণ অনেক কস্টকর। যার কারনে অনেকেই এই সালাত আদায় করতে পারেন না। এই নিয়ে আরেকটি হাদিসে বর্নীতে হয়েছেঃ
“রাত জাগরণ অনেক কস্টকর এবং ভারি, তাই তোমরা এশার নামাজ আদায় করার পর যখন বিতর পড়বে তখন তোমারা ২ রাকাত বা ৪ রাকাত সালাতুল তাহাজ্জুদ এর সালাত আদায় করে নিবে। এতে তোমরা তাহাজ্জুদ এর ফজিলত এর অন্তর্ভুক্ত হবে।”
( সুনানে দারেমি ১৬৩৬)
সুতরাং, বুঝতেই পারছেন আপনি যদি রাত জেগে না পড়তে পারেন তাহলে এশার নামাজ এর পড়তে পারেন।
তাহাজ্জুদ এর নামাজ নিয়ে আরেকটি হাদিসে এসেছে,
“ফরজ সালাতের পর সর্বওম সালাত হলো রাতের (তাহাজ্জুদ) নামাজ।”
( সহীহ মুসলিম ১১৬৩)

তাহাজ্জুদ এর নামাজ নফল নাকি সুন্নত
অনেক মানুষ এই বিষয় নিয়ে চিন্তা করেন যে এই নামাজ নফল নাকি সুন্নত। এই নিয়ে অনেক আলেমগণ অনেকভাবে ব্যাখা করেছেন। অনেকের মতে এটি সুন্নত আবার অনেকের মতে এটি নফল আবার অনেকে এটিকে নফল এবং সুন্নত উভয়টাই বলেছেন। । আজকে এই বিষয়টি আমরা পরিষ্কার করার চেস্টা করবো। চলুন জেনে নেওয়া যাকঃ
১ঃ যারা তাহাজ্জুদ এর নামাজ নফল মনে করেছেন তাদের মতেঃ তাহাজ্জুদ এর নামাজ মহান আল্লাহ তায়ালা ফরজ এর পরে বিশেষ সময় এর মধ্যে পড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন এই নামাজ যে পড়বে তাকে মহান আল্লাহ তায়ালা সম্মানিত করবেন। এই নামাজ পড়লে ভালো আবার না পড়লে কোনো সমস্যা নেই। তাই এটি নফল।
২ঃ যারা তাহাজ্জুদ এর নামাজ কে সুন্নত মনে করেছেন তাদের মতেঃ হাদিসের আলোকে আলোকে আমরা জানতে পারি যে মহান আল্লাহ তায়ালা এই নামাজ কে রাসুল (সঃ) এর উপর ফরজ করেছেন। রাসুল (সঃ) কখোনই এই নামাজ মিস করেননি। তিনি এই নামাজ কে অনেক গুরুত্ত দিতেন এর ফজিলত এর কারণে। মহান আল্লাহ এর কাছে সবথেকে প্রিয় হওয়ার তিনি এই নামাজ বেশি বেশি পড়তেন। আর আমরা সকলেই জানি রাসুল(সঃ) যা করে গেছেন তা আমাদের জন্য সুন্নত। যেহেতু তিনি রি নামাজ এর উপর গুরুত্ত দিয়েছেন তাই এটি সুন্নত।
৩ঃ যারা এই নামাজ কে নফল এবং সুন্নত বলেছেন তাদের মতেঃ অনেক ইসলামি গবেষক এই নামাজকে উভয়টি বলেছেন। নফল এবং সুন্নত এর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এই উভয়গুলো করলে ভালো না করলে কোনো সমস্যা নেই। তাই এটিকে বিভক্ত করে বেশি বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। মূলতো নফল এবং সুন্নত এই বিষয়গুলো একই।
আমরা কোনটি গ্রহন করবোঃ আমরা চাইলে তিনটির মধ্যে যেকোনো একটি গ্রহন করতে পারি। এটি নফল নাকি সুন্নত সেটি মুখ্য বিষয় নয়। মূল বিষয় হলো আমরা এই নামাজটি পড়ার চেস্টা করবো। এটিকে সুন্নত বা নফল মনে করে আদায় করলে কোনো সমস্যা নেই। যদি মনে করেন সুন্নত তাহলে এটি সুন্নত আবার যদি মনে করেন নফল তাহলে এটি নফল। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হলো মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তোষ্টি অর্জন করা।
আরোও পড়ুনঃ সালাতুল হাজত নামাজের নিয়ম ও ফজিলত গুলো কি কি?
তাহাজ্জুদ নামাজ কতো রাকাত?
তাহাজ্জুদ নামাজ ৮ রাকাত নাকি ১২ রাকাত এটি নিয়ে অনেকে তর্ক-বিতর্ক করেন। আজকে আমরা হাদিসের আলোকে জানবো যে তাহাজ্জুদ নামাজ কতো রাকাত। বুখারী শরীফ এর হাদিস থেকে পাওয়া যায়ঃ
হযরত আয়শা (রাঃ) হতে বর্নীত, রাসুল(স:) তাহাজ্জুদ এর সালাত ২ রাকাত করে মোঠ ১১ রাকাত পড়তেন। এর মধ্যে ৩ রাকাত হলো বিতর এবং ৮ রাকাত হলো তাহাজ্জুদ। তাহলে হাদিসের আলোকে বুঝা যায় যে এই নামাজ ৮ রাকাত।
তাহাজ্জুদ এর সালাত কতো রাকাত করে পড়তে হবে?
হাদিসে বর্নীত আছে তাহাজ্জুদ ৮ রাকাত। তাহলে আপনি ৮ রাকাত পড়তে পারবেন। তবে এই ৮ রাকাত একাসাথে পড়া যাবেনা। আপনি ২ রাকাত করে পড়তে হবে এবং মোঠ ৪ করে ৮ রাকাত শেষ করতে হবে। তবে ৮ রাকাত এর কম পড়লেও কোনো সমস্যা নেই। আপনি চাইলে ২ রাকাত বা ৪ রাকাত ও পড়তে পারবেন। তবে সর্বনিম্ন আপনাকে অন্তত ২ রাকাত আদায় করতে হবে।
কখন তাহাজ্জুদ এর সালাত আদায় করবো?
হ্যাদিস থেকে পাওয়া যায় এই সালাত এশার নামাজ এর পর থেকে ফজর এর আযান এর পুর্বপর্যন্ত পড়া যায়। তবে এর সময় নিয়ে অনেক মতাদর্শ রয়েছে। তবে সবথেকে গ্রহনযোগ্য যেটি হলো মধ্যরজনীতে অর্থাৎ ফজরের পুর্বে এটি আদায় করা সব থেকে ভালো। এই সময় এ মহান আল্লাহ তার বান্দাদের কে ডাকেন। তাই এই সময়ে পড়া সবত্যহেকে উত্তম। তবে আপনি চাইলে এশার নামাজ এর পর আদায় করতে পারবেন এতে কোনো সমস্যা নেই।
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত ( আরবি এবং বাংলা)
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম জানার আগে তার নিয়ত জানা জরুরি। কারন আপনাকে নামাজ পড়তে হলে অবশ্যই তার নিয়ত পড়তে হবে। নিচে আরবি এবং বাংলা নিয়ত দেওয়া হলোঃ
- আরবি নিয়তঃ নাওওয়াইতা নুসাল্লিয়া লিল্লাহী তায়ালা। রাকাতাই সালাতি ,তাহাজ্জুদ সুন্নতি রাসুলুল্লাহি তায়ালা ,মুতাওাজ্জিহান ইলা জিহাতিল, কাবাতি শরিফাতি আল্লাহ আকবর।
- বাংলা নিয়তঃ আমি ২ রাকাত তাহাজ্জুদ এর নামাজ কিবলামুখী পড়ার নিয়ত করিতেছু। আল্লাহ আকবর।
আপনি বাংলা এবং আরবি যেকোনো নিয়তে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করতে পারবেন এতে কোনো সমস্যা নাই।

তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম অন্য সব নামাজের মতোই। এর কোনো ধরাবাধা নিয়ম নেই বা এর জন্য কোনো নিয়ম হাদিসে বর্নীত হয়নি। নিচে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম দেওয়া হলোঃ
- প্রথমে উত্তম রুপে অযু করতে হবে।
- তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ত করতে হবে।
- এর পরে তাকবিরে তাহরিমা বাধার পর সানা পাঠ করতে হবে।
- সুরা ফাতেহা পাঠ করতে হবে
- ফাতেহা পড়ার পর আপনি যে সুরা ভালো পারেন সেটি পাথ করবেন।
- পরে রুকুতে যেতে হবে এবং রুকু শেষ করার পর সেজদায় যেতে হবে।
- সেজদা শেষ করার পর আবার উঠে দাড়াতে হবে এবং আবার ফাতেহা পাঠ করার পর সেজদা শেষ করার পর আত্তাহিয়াতু এবং দোয়ায়ে মাছুরা পাঠ করার পর সালাম ফিরাতে হবে।
- এভাবে তাহাজ্জুদ এর সালাত আদায় করতে হবে।
আপনি অন্য নামাজ যেভাবে পড়েন ঠিক সেভাবেই তাহাজ্জুদ এর নামাজ আদায় করবেন। উপরে দেওয়া নিয়মগুলোর মাধ্যমে এটি পড়তে পারবেন।
তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার জন্য কোন কোন সূরা পড়বো?
এই নামাজ পড়ার জন্য বিশেষ কোনো সূরার কথা উল্লেখ নেই। আপনি যেকোনো সূরা পাঠ করতে পারবেন। আপনি যেই সূরা ভাল পড়তে পারেন সেটা দিয়ে পড়বেন। তবে মহানবী (সঃ) তাহাজ্জুদ এর নামাজ খুব দীর্ঘ করতেন। তিনি অনেক লম্বা লম্বা সূরা পড়তেন। তাই আপনি ও যে বড় সূরাগুলো জানেন সেইগুলা দিয়ে পড়ার চেস্টা করবেন।
তাহাজ্জুদ নামাজের দোয়া কিভাবে পড়বেন?
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম তো জানলেন। এবার জেনে নিন এর দোয়া কিভাবে পড়তে হয়। আমাদের সকলেই জীবনের একটি উদ্দেশ্য থাকে যা আমরা চেস্টার করার পরও না পেতে পারি। কিন্তু মহান আল্লহা এর কাছে চাইলে তা তিনি আমাদের জন্য সহজ করে দেন। তাহাজ্জুদ এর নামাজ পড়ে দোয়া করলে সেটি পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাহাজ্জুদ এর পড় আপনি যেকোনো আরবি দোয়া পাঠ করতে পারবেন। নিচে কিছু দোয়া দেওয়া হলোঃ
- রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানা ওয়াফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়াকিনা আযাবান্নার
- রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা।
- লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুভানাকা ইন্নি কুন্তুত্ম মিনাজ যোয়ালিমিন।
- দরুদে ইব্রাহিম।
তাহাজ্জুদ নামাজের কিছু ফজিলত
তাহাজ্জুদ নামজের অনেক ফজিলত রয়েছে। নিচে কিছু বর্ণ্না করা হলোঃ
- এই নামাজ নিয়মিত আদায় করলে মহান আল্লাহ তায়ালা তার সম্মান বাড়িয়ে দেন।
- এই নামাজ এর মাধ্যমে কোনো কিছু চাইলে মহান আল্লাহ তা পূরন করে দেন।
- মহান আল্লাহ এর কাছে প্রিয় হওয়া জায়।
- মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায়।
- বান্দার রিজিক এর মধ্যে বরকত চলে আসে।
উপসংহার
তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম নিয়ে আমরা এই কন্টেন্টটি ভালোভাবে সাজিয়েছি। তাহাজ্জুদ নামাজ নিয়মিত পড়ার চেস্টা করবেন। কারণ মহান আল্লাহ এর কাছে এই নামাজটি অনেক প্রিয়। আমাদের রাসুল (সঃ) এটি নিয়মিত পড়তেন। আপনি ৮ রাকাত না পারলে ও অন্তত ৩ রাকাত পড়ার চেস্টা করবেন। ধন্যবাদ সবাইকে।
One Comment on “তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম কোরআন এবং হাদিসের আলোকে”